এইচ পাইলোরি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা ও খাবার।

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি বা এইচ পাইলোরি হল এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা আমাদের পাকস্থলীর আবরণের ইনফেকশন তৈরি করে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগ পেপটিক আলসারের কারণ হলো হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি । আর উন্নত দেশগুলিতে ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পেপটিক আলসার হয় এর কারণে।

আমাদের দেশে পেপটিক আলসারের বা পেটের আলসারের একটি বড় কারণ হলো এইচ পাইলোরি ইনফেকশন। আলসার আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি রোগ। কিন্তু আলসারের একটি বড় ফ্যাক্ট হচ্ছে এই ব্যাকটেরিয়া যা আমরা অনেকেই জানিনা।

প্রোবায়োটিক বিষয়ে একটু জেনে নেয়া যাক। প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা আমাদের পেটে থাকে। আমাদের নানাভাবে উপকার করে এই ব্যাকটেরিয়া। এইচ পাইলোরির মতো খারাপ ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে বাধা দেয় প্রোবায়োটিক। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস নামের উপকারী ব্যাকটেরিয়া।

{tocify} $title={Table of Contents}

এইচ. পাইলোরির লক্ষণ

এইচ পাইলোরি খাবার ও ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ব্যাকটেরিয়া পেটে থাকলেও কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায় না। রোগী নিজেও বুঝতে পারে না সে এই সমস্যায় রয়েছে। এর কারণে পেপটিক আলসার বিকাশ লাভ করলে নিচের উপসর্গ গুলো দেখা দিতে পারে।
  • পেটে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া
  • বমি বমি ভাব ও বমি হতে পারে
  • ক্ষুধামান্দ্য 
  • পেট ফাঁপা
  • ঢেকুর ওঠা
  • শরীরের ওজন কমে যেতে পারে
  • পেট খালি থাকলে ব্যাথা বৃদ্ধি পায়
এইচ পাইলোরির নির্মূলে চিকিৎসকরা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করে। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, খাবারের প্রতি অনিহা ইত্যাদি।

ঘরোয়া চিকিৎসা

বিশেষজ্ঞদের মতে চিকিৎসায় ইহা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায় না শুধু কমানো যায়। যাইহোক চিকিৎসার গতি ত্বরান্বিত করতে ঘরোয়া চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা করে। একে একে জেনে নিন ঘরোয়া প্রতিকার গুলো সম্পর্কে।

প্রোবায়োটিক

আমরা ইতোমধ্যে প্রোবায়োটিক সম্পর্কে জেনেছি। পেটে ভালো ব্যাকটেরিয়া ও খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ব্যালেন্স থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইচ পাইলোরির চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে ভালো ও খারাপ উভয় ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যায়। প্রোবায়োটিক ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

টক দই একটি প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার। অর্থাৎ টক দইয়ে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। দই খেলে এর উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও আমাদের পেটের উপকারী ব্যাকটেরিয়া একসাথে মিলে পেটের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করবে। তাছাড়া পেটের চর্বি কমাতে সাহায্য করে প্রোবায়োটিক। এইচ পাইলোরির চিকিৎসায় দ্রুত সুফল পেতে প্রোবায়োটিক খাবারের খুব ভালো কাজ করে।

কারকিউমিন 

কারকিউমিন হলো একটি শক্তিশালী অ্যন্টি-অক্সিডেন্ট যা হলুদে পাওয়া যায়। এটি এই ব্যাকটেরিয়াকে পেটে আলসার সৃষ্টি করতে বাধা দেয়। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং দ্রুত আলসার নিরাময়ে সাহায্য করে।

গ্রিন টি

গ্রিন টিতে এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে বাধা দানকারী উপাদান থাকে। এই সবুজ চায়ে পলিফেনল নামের কম্পাউন্ড থাকে। যা শরীরে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ কমায়। শরীরে ফ্যাট কমাতে স্বল্পমেয়াদি কার্যকারিতা রয়েছে এই চায়ের। গ্রিন টিতে ক্যাফেইন থাকে তাই অতিরিক্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।

অলিভ অয়েল

চিকিৎসকরা আলসারের রোগীদের তেল চর্বি জাতীয় খাবার গুলো খেতে নিষেধ করেন। অলিভ অয়েল একটি স্বাস্থ্যকর তেল। রান্না এবং ভর্তা ভাজিতে ব্যবহার করুন অলিভ অয়েল। শরীরের জন্য খুবই উপকারী এই তেল। এইচ পাইলোরি ইনফেকশন প্রতিরোধ করে এই তেল। তাছাড়া হাড় মজবুত হয় ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর মত উপকারীতা রয়েছে অলিভ অয়েলে।

দুধ

গরুর দুধে ল্যাকটোফেরিন নামের এক ধরনের গ্লাইকোপ্রোটিন থাকে। ল্যাকটোফেরিন এইচ পাইলোরি সংক্রমণ কমাতে পারে যা গবেষণায় প্রমাণিত। একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ১৫০ জন এইচ পাইলোরি রোগীকে ল্যাকটোফেরিন ও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে একসাথে চিকিৎসা প্রদান করায় তারা শতভাগ সাফল্য পেয়েছে।

দুধের ক্যাসিন ও চিনির ল্যাকটোজের সংমিশ্রণে তৈরি হয় মেলানয়েডিন নামের এক ধরনের কম্পাউন্ড। এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে বাধা তৈরি করে এই পদার্থটি।

অ্যালোভেরা

কোষ্ঠকাঠিন্য ও দ্রুত ক্ষত সারাতে অ্যালোভেরা খুব কার্যকর। একটি গবেষণায় দেখা গেছে অ্যালোভেরার নির্যাস এইচ পাইলোরি স্ট্রেনের বৃদ্ধি এবং ধ্বংস উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর। এইচ. পাইলোরি চিকিৎসায় অন্যান্য ওষুধের সাথে অ্যালোভেরা পাতার নির্যাস দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে।

মধু

মধুর রয়েছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল পাওয়ার। মধু এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। তার মানে এই নয় মধু অ্যান্টিবায়োটিক এর মত কাজ করে। এটি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে কিন্তু ধ্বংস করতে পারে না। মধু খেলে উপকার হবে তবে ডাক্তারের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

মধুর আরো অনেক উপকারিতা হয়েছে। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হার্ট সুস্থ রাখে। তবে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। মধু বেশি খাওয়ার কারণে ওজন বাড়াতে পারে কারন এতে প্রচুর সুগার আছে।

এইচ. পাইলোরির খাবার

এইচ পাইলোরি ইনফেকশনের কারণে পেটে আলসার হয়। তাই আলসার প্রতিরোধ করতে হলে এইচ পাইলোরি ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে হবে। তালিকা হতে বাদ দিতে হবে কিছু খাবার যদিও আপনার পছন্দের খাবার হয়। যেমন: অ্যালকোহল ও তামাক একেবারে ছেড়ে দিতে হবে। অতিরিক্ত তেল চর্বি ও লবণ যুক্ত খাবার এবং মসলাদার খাবার বাদ দিতে হবে।

বাদ দিতে হবে সব ভাজাপোড়া খাবার। চা, কফি ও চিনি যুক্ত ড্রিংকস ও খাবার এইচ পাইলোরি থেকে সুস্থ হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। যে ফল খেলে পেটে এসিড বাড়ে সেগুলো খাওয়া যাবে না। যেমন: লেবু, জাম্বুরা, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি সাইট্রাস ফল ও টমেটো খেলে পেটে এসিড বাড়ে। এই জাতীয় খাবার গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। চকলেট, আইসক্রিম, জুস  ইত্যাদি চিনি ও কৃত্রিম উপাদান মেশানো খাবার এইচ পাইলোরি ইনফেকশন বা আলসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

খেতে হবে এইচ পাইলোরি নিরাময়ের সাহায্য করে এমন খাবার। যেমন: হলুদ, টক দই, অ্যালোভেরা নির্যাস, মধু, গ্রিন টি, অলিভ অয়েল ইত্যাদি। এসময় সব ধরনের পুষ্টিকর স্বাভাবিক খাবার চালিয়ে যাবেন। পেটে এসিড বাড়ে এমন খাবার ছাড়া সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার খেতে পারবেন। সহজে হজম হয় এমন সব খাবারের প্রতি ফোকাস রাখা দরকার দ্রুত সুস্থ হতে চাইলে।

শেষ কথা

বেশিরভাগ গ্যাস্ট্রিক এবং ডুওডেনাল আলসার সৃষ্টির পেছনে এই ব্যাকটেরিয়া অবদান রাখে। এর চিকিৎসা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর কারণে। এইচ পাইলোরি চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি সহায়ক ভূমিকা রাখবে এই ঘরোয়া পদক্ষেপ গুলো।

আশা করি এই পোস্টটিতে যে বিষয় গুলো তুলে ধরা হয়েছে আপনাদের উপকারে আসবে। এটি একটি শিক্ষামূলক পোস্ট। স্বাস্থ্য বিষয়ক কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিবেন।

N.Islam

আমি মোঃ নুরুল ইসলাম একজন সাধারণ ব্লগার। আমি পেশায় একজন কমিউনিটি প্যারামেডিক ও ফার্মাসিস্ট।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post