আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গুলোর মধ্যে একটি হল ভিটামিন। ভিটামিন দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই আমাদের শরীরে সব ধরনের ভিটামিন প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকা উচিত।
ভিটামিন-এ মানব দেহের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন। ভিটামিন এ এর অভাবে শরীরে দেখা দেয় নানা স্বাস্থ্য সমস্যা। যেমনঃ ভিটামিন এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। তাই সুস্থ থাকতে হলে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। তাই আমাদের জানতে হবে কোন খাবারগুলোতে ভিটামিন এ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে। এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ুন তাহলেই জানতে পারবেন কোন খাবারগুলোতে ভিটামিন এ সবচেয়ে বেশি থাকে।
ভিটামিন এ এর আরেক নাম হল রেটিনাল। একজন পূর্ণ বয়স্ক মহিলার দেহে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ থাকা প্রয়োজন। একজন পুরুষের দেহে প্রতিদিন ভিটামিন-এ এর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মাত্রা হলো ৯০০ মাইক্রোগ্রাম। এই বিষয়টা খেয়াল রেখে আমাদের ভিটামিন-এ জাতীয় খাবার গুলো খেতে হবে।
ভিটামিন এ এর কাজ কি
ভিটামিন এ কোষের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া ভিটামিন-এ ভ্রুনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-এ নানা ধরনের সংক্রামক রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশেও রয়েছে এর অবদান। দেহে প্রয়োজনীয় মাত্রায় ভিটামিন-এ থাকলে ত্বক শুষ্ক হয় না, ফলে ত্বক সতেজ থাকে। টিউমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধে ভিটামিন-এ এর যথাযথ ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন এ জাতীয় খাবার তালিকা
ভিটামিন এ মূলত একটি ফ্যাট সলিউবল পুষ্টি উপাদান যা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজন। ভিটামিন এ এর অভাবে অন্ধত্ব, ত্বকের বিভিন্ন রোগ সহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে।
ভিটামিন এ এর অভাব জনিত রোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। জন্য আমাদের ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবারগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ নিবন্ধে কতগুলো খাবার সম্পর্কে জানানো হয়েছে যেগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন-এ রয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এই খাবার গুলো সম্পর্কে।
আরো পড়ুন
মিষ্টি আলু
একটি মিষ্টি আলুতে আমাদের দৈনিক প্রয়োজনীয় ভিটামিন-এ এর গড় মাত্রার ১৫৬ শতাংশ পাওয়া যায়। মিষ্টি আলুতে ভিটামিন-এ সাধারণত বিটা-ক্যারোটিন আকারে থাকে।
বয়সের কারণে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন নামের চোখের দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি জনিত এক ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিটা ক্যারোটিন এই রোগ হতে চোখকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাছাড়া বিটা ক্যারোটিন প্রোস্টেট ক্যান্সার সহ কয়েক ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে মিষ্টি আলুর যথাযথ কার্যকারিতাও কম নয়। মিষ্টি আলুতে নিম্নমাত্রায় ক্যালোরি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন বি সিক্স, ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম রয়েছে।
পালং শাক
পালং শাক পুষ্টগুনে ভরপুর। সব ধরনের শাক-সবজিতেই প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি থাকে। তবে পালং শাকে ভিটামিন-এ এর পরিমাণ একটু বেশি রয়েছে। পালং শাকে ভিটামিন-এ ছাড়াও আরো রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান।
আধা কাপ সেদ্ধ পালংশাকে আমাদের দৈনিক প্রয়োজনীয় গড় মাত্রার প্রায় ৬৪ শতাংশ ভিটামিন এ, ১৭ শতাংশ আয়রন ও ১৯ শতাংশ ম্যাগনেসিয়াম থাকে। কিছু গবেষক মনে করে পালং শাক রক্তচাপ কমাতে ও হার্ট সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যাইহোক, এই বিষয়টা নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন।
কলিজা
আমাদের লিভার ভিটামিন-এ সঞ্চয় করে রাখে। ঠিক একই ভাবে অন্যান্য প্রাণীর লিভার বা কলিজাতেও ভিটামিন-এ সঞ্চিত থাকে। তাই কলিজা হল ভিটামিন-এ এর একটি অন্যতম উৎস।
৮৬ গ্রাম প্যান ফ্রাইড গরুর কলিজায় প্রায় ৬,৫৮২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ রয়েছে যা আমাদের দেহের জন্য দৈনিক গড় চাহিদার ৭৩১ শতাংশ। কলিজাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। কলিজাতে আরো রয়েছে-
- কপার
- আয়রন
- ফোলেট
- কোলিন
- ভিটামিন বি টু
- ভিটামিন বি টুয়েলভ
তাই দেহের জন্য প্রয়োজনীয় এই ভিটামিন গুলো পেতে কলিজা খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হাই কোলেস্টেরল রোগীদের কলিজা খাওয়া উচিত নয়।
কড লিভার অয়েল
কড লিভার অয়েল ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-ডি তে ভরপুর। কড লিভার অয়েল হলো কড মাছের কলিজা থেকে আহরণ করা তেল। অধিকাংশ মাছের তেলের মতোই কড লিভার অয়েলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি অর্থাৎ প্রদাহরোধী হিসেবে কাজ করে। হার্ট সুস্থ রাখতে এবং বিষন্নতা প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড অত্যন্ত কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত।
আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও হাড় ভালো রাখতে প্রয়োজন ভিটামিন-ডি। কড লিভার অয়েলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ডি। ১ টেবিল চামচ কড লিভার অয়েলে আমাদের দেহের জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় গড় পরিমাণের ১৭০ শতাংশ ভিটামিন ডি রয়েছে।
একথা স্পষ্ট যে, কড লিভার অয়েলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ রয়েছে। আরো রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন-ডি।
গাজর
গাজর হল কমলা রঙের একটি মূল। গাজর আমাদের কাছে সবজি হিসেবেই বেশি পরিচিত। গাজরে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন। গাজরে এই বিটা ক্যারোটিন মানুষের শরীরে ভিটামিন-এ তে পরিণত হয়। একটি বড় গাজরে প্রায় ২৯ ক্যালোরি থাকে।
মাত্র ৫০ গ্রাম গাজরে ৪৫৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ রয়েছে যা আমাদের দেহের জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় গড় পরিমাণের ৫১ শতাংশ। তাছাড়া গাজরের ফাইবার রয়েছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
সাধারণত গাজর আমাদের দেশে সালাদ হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয়। গাজর দিয়ে তৈরি করা যায় গাজরের হালুয়া যা ছোট বড় সবার কাছে একটি সুস্বাদু খাবার। রান্নায় অন্যান্য সবজির সাথে গাজর তরকারির স্বাদ বাড়ায়। খোসা ছাড়িয়ে লবণ মরিচ দিয়ে গাজর খেতে অনেক মজা।
মিষ্টি কুমড়া
মিষ্টি আলু ও গাজরের মত মিষ্টি কুমড়াতেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন। মিষ্টি কুমড়া আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে মিষ্টি লাউ নামে পরিচিত। ১০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়ায় প্রায় ৭২০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ রয়েছে।
ভিটামিন-এ ছাড়াও মিষ্টি কুমড়াতে আরো রয়েছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। মিষ্টি কুমড়ার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ক্যান্সার ও আলজেইমার রোগের ঝুঁকি কমায়।
বিভিন্ন দেশে মিষ্টি কুমড়া সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। আমাদের দেশে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে সবজি ও তরকারি বানানো হয়।
টমেটো
আমাদের দেশে শীতকালে যে সবজিগুলো সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় টমেটো সেগুলোর মধ্যে একটি। টমেটো তরকারি এবং সালাদের সাথে খাওয়া যায়। টমেটো ভর্তাও একটি সুস্বাদু খাবার।
১০০ গ্রাম টমেটোতে ৪২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ থাকে। টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি থাকে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এই দুটি ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দুধ
দুধে রয়েছে ভিটামিন-এ হোক সেটা গরু, ছাগল বা মহিষের। ১ কাপ দুধে প্রায় ১১২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ থাকে। তবে যাদের হজমে সমস্যা রয়েছে অর্থাৎ দুধ খেলে বদহজম হয় তাদের দুধ খাওয়া উচিত নয়। শরীরে ভিটামিন-এ এর চাহিদা মেটাতে দুধের পরিবর্তে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার গুলো খেতে পারেন।
ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ার নিয়ম
দৈনিক খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ জাতীয় খাবার গুলো রাখলে ভিটামিন-এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। যাইহোক, ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ার নিয়ম জেনে রাখা ভালো। তবে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
উচ্চমাত্রায় ভিটামিন-এ গ্রহণে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে টক্সিক মাত্রায় ভিটামিন-এ গ্রহণের ফলে তার গর্ভের সন্তানের জন্মগত ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন-এ গ্রহণের ফলে লিভার, হাড় ও ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। তাই ভিটামিন-এ ক্যাপসুল গ্রহনের পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
শরীরে ভিটামিন-এ এর ঘাটতি ও চাহিদা অনুযায়ী ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খেতে হবে। আমাদের দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ক্লিনিকে বিনামূল্যে শিশুদেরকে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। আপনার শিশুর ভিটামিন-এ ক্যাপসুলের কোন ডোজ যেন বাদ না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই আপনার শিশুর দেহে থাকবে না ভিটামিন-এ এর ঘাটতি।
আমাদের শেষ কথাঃ এই নিবন্ধে ভিটামিন এ সবচেয়ে বেশি থাকে এমন ৮ টি খাবার সম্পর্কে জানানো হয়েছে। ভিটামিন-এ ছাড়াও খাবারগুলো অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। এই খাবারগুলো দৈনিক খাদ্য তালিকায় রাখলে শরীরে ভিটামিন-এ এর ঘাটতি থাকবে না। যার ফলে ভিটামিন-এ এর ঘাটতি জনিত রোগগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন-এ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।